Warning: Undefined array key "options" in /home/prabandh/public_html/wp-content/plugins/elementor-pro/modules/theme-builder/widgets/site-logo.php on line 124
মায়ের ব্যাকুলতা - Prabandha Archive

Menu

Description

মায়ের ব্যাকুলতা

সুলেখা আক্তার শান্তা

 

আনন্দের জোয়ারে ভাসছে কল্পনা বেগমের মন। দুই ছেলে বাড়িতে আসবে। আসার দুইদিন আগে থেকেই বাড়িঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে। ছেলে, বউ, নাতি, নাতনিরা কি কি খাবে, তাদের পছন্দমত খাবারের আয়োজন চলছে। কল্পনার চোখে চশমা, হাতে ভর দিয়ে হাঁটার লাঠি। মোড়া পেতে উঠানে বসে টুটুলকে হুকুম করছেন এটা ওটা করার। তোর তো কাজে আবার দেরি হয়, তাড়াতাড়ি হাত চালিয়ে কর। টুটুল কাজ করতে করতে তার মনের কথাটা বলে ফেলে। খালাম্মা, এই আমি বললাম, দেখবেন আপনার দুই ছেলের কেউ আসবে না। কল্পনা রেগে যায়, ধুর হতছড়া, মুখপোড়া, দেখিস আমার ছেলে, বউ, নাতি, নাতনি ঠিকই চলে আসবে।
শোন যে কদিন আমার ছেলেরা থাকবে রোজ পুকুর থেকে মাছ তুলবি। আর গরুর তো দুধ দেয়। হাঁস, মুরগি তো আছেই, খাসির মাংসও নিয়ে আসবি। খেয়াল রাখবি রান্নাটা যেন ঠিকঠাক মতো হয়। সবই করা যাবে আপনার ছেলে, বউরা আগে আসুক। আসবে আসবে সবাই আসবে। আমি বাড়ির উঠানে মাদুর বিছিয়ে নাতিদের নিয়ে বসে গল্প করব। ওরা আমার চোখের সামনে ছোটাছুটি করবে খেলবে আমি দেখব। টুটুল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, কত না স্বপ্নই দেখছে ছেলে, বউ, নাতি নিয়ে। কল্পনা বেগম আরো নির্দেশনা দিতে থাকেন। শোন টুটুল, মুড়ির জন্য চাউল করা আছে। তুই ফুলির মাকে বলিস, আমার ছেলেরা যখন আসবে তখন মুড়ি ভেজে দেবে। গরম গরম মুড়ি আমার ছেলেদের খুব পছন্দ। ঠিক আছে বলবো। ছেলেদের বাড়ি আসার কথা শুনেই কল্পনা বেগম এত আনন্দ ছেলেরা বাড়ি আসলে না জানি সে কতটা আনন্দিত হতো।
আরও পড়ুন, জেমস জয়েসের গল্প- ইউলিসিস
ছেলেদের বাড়ি আসার তারিখের দুইদিন পার হয়ে যায়। দুই ছেলের এক ছেলেও আসে না। বড় ছেলে মইনুদ্দিনের কাছে ফোন করে কল্পনা। ছেলের কাছে জানতে চান, বাবা বাড়ি আসলি না কেন? মইনুদ্দিনের ব্যস্ততার উত্তর, চাইলেই তো আর যাওয়া যায় না মা। আমার ব্যবসা-বাণিজ্য, তোমার বৌমার চাকরি। বাচ্চাদের স্কুল। আর হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। ঘর সংসার, এসব সামলানো কি চারটি খানি কথা মা! বললেই হয় না মা। ছেলের মুখে এমন কথা শুনে কল্পনা বেগমের মুখ মলিন হয়ে যায়। কি মা কথা বলছো না কেন? না বাবা আমি আর কি বলবো? আসলেই তো আমার এসব ভেবে দেখা উচিত ছিল। মা তুমি মন খারাপ করো না। ফারহানার মা অসুস্থ। সে তার নাতিদের দেখতে চাইছে। ফারহানা বাচ্চাদের নিয়ে মায়ের ওখানে যাবে। কয়েকদিন ওখানে থাকবে। আমারও সেখানে যেতে হবে মা।
প্রথমে ছেলের কথা শুনে ব্যবসার ব্যস্ততা, নাতিদের স্কুল, বৌমার চাকরি, এসব নিয়ে ভাবছিল কল্পনা বেগম। পরে যখন শুনলো ছেলের শাশুড়ির কথা, তখন কল্পনার মনটা খারাপ হয়ে যায়। বুঝতে পারে বাড়ি না আসার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণ। মনঃক্ষুন্ন হয়ে বলে, হ্যাঁ বাবা সেখানেই যাও। মা তো আপন নয় এখন শাশুড়ি আপন। মইনুদ্দিন ফোনে একটু উচ্চস্বরে বলছে, মা তুমি এসব কি বলছ? কল্পনা বেগম নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করে। ঠিক আছে বাবা, এখন মায়ের ভুলটাও ধরতে হবে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির কোন কিছু নিয়ে ভাবলে বাবা মার কাছে মনে হয় তাদের সন্তানরা বুঝি আপন থাকল না। মনে হয় শ্বশুর বাড়ির জন্য সব করে ফেলল।
ঠিক আছে বাবা আর কথা বাড়াইস না। মা এই কথা যদি ফারহানা শুনত তাহলে ও কি ভাবতো? কল্পনা মনে মনে ভাবে সন্তানকে দেখার জন্য মায়ের ব্যাকুলতা সন্তানরা বুঝতে পারে না। মা তো সন্তানের মুখ দেখে অনুভূতিতে সবই বুঝে। সন্তানও যদি এরকম বুঝতো তাহলে মুখ ফুটে বলতে হতো না। মইনুদ্দিন বলে, কি ব্যাপার চুপ করে আছো কেন কিছু বলো? সম্বিত ফিরে পেয়ে কল্পনা বেগম বলেন, কি আর বলবো সবই তো শুনলাম। মা তাহলে এখন রাখি, ব্যস্ত আছি।
ঠিক আছে বাবা ভালো থাকিস। নিজের প্রতি খেয়াল রাখিস। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস। মা তোমারে এই একইকথা কতবার বলবা? আমার কি কোন কিছুর কম আছে, খাওয়া পরার! তুমি বললে, খাব, না হলে খাবো না। তুমি বললে শরীরের যত্ন নেব না হলে নেব না। বাবারে মায়ের মন ব্যাকুল হইয়া থাকে সন্তানের জন্য। সন্তান কি খেলো না খেলো, সন্তান ভালো আছে নাকি নাই। কোন কিছু থাকা না থাকা তো বড় কথা না। মা তোমার এই উপদেশগুলো মুখস্থ হয়ে গেছে আর বলার দরকার নাই। আচ্ছা বাবা। কল্পনা বেগম ফোন রাখে একটা দীর্ঘশ্বাসে। বড় ছেলে তো আসতে পারলো না বিভিন্ন কারণে, দেখি ছোট ছেলেটার কি অবস্থা।
আরও পড়ুন, ইভান তুর্গনেভের গল্প- অনাবাদী জমি
ছোট ছেলেকে কাছে ফোন দেয়। রেজাউদ্দিন আহমেদ ফোন ধরে। বড় ছেলে মইনুদ্দিনের মতোই ছোট ছেলের কথা। নিজের ব্যবসা, বাচ্চাদের স্কুল, মা এগুলি নিয়ে যখন ইচ্ছা তখন যাওয়া যায় না।  আর যাওয়া আসার তো একটা ধকল আছে। সেগুলি সামাল দিয়ে পারা যায় না। ঠিক আছে বাবা। পাশে থেকে রেজাউদ্দিনের ছেলে-মেয়েদের কথা শোনা যায়। দাদি ফোন করেছে ফোনটা দাও, দাদির ওখানে যাব বাবা। তোমরা থাম তো! মা এই বাড়ি যাওয়ার কথা নিয়ে ফোন দিবা না। এটা বলে দিলা তো ছেলে মেয়েদের মাথা নষ্ট করে। ওরা ছোট মানুষ অত কিছু বোঝেনা। ওরা তো যেতে চাইবেই, পরিস্থিতি তো ওরা বুঝে না।
রেজাউদ্দিনের ছেলে বলে, বাবা দাদির সঙ্গে তুমি এভাবে কথা বলছো কেন? রেজাউদ্দিন সংযত হয়। যাও বাবা পড়তে বসো, সামনে পরীক্ষা। না, দাদির সঙ্গে কথা বলব। মা এই নাও কথা বলো নাতির সঙ্গে কিন্তু বাড়ি যাওয়ার উস্কানি দিওনা। কল্পনা বেগম নাতির সঙ্গে কথা বলেন, দাদুভাই ভালো আছো? হ্যাঁ দাদি ভালো আছি। সজীব বলে, দাদি তুমি আমাদের এখানে আসো বেড়াতে। না দাদুভাই, পরে আসবো। দাদি আমি তোমার ওখানে যাব। এসো, তুমি বড় হও তখন এসো। তখন তো তোমাকে কেউ আটকাতে পারবেনা। দাদি তখন তো যাবই কিন্তু আমি এখন যেতে চাই। রেজাউদ্দিন ছেলের কাছ থেকে ফোন নেয়।
মা দিলে তো ছেলের মন খারাপ করে। গ্রামের পরিবেশ কোন পরিবেশ! ওখানে ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকা যায়? ভালোভাবে ছেলে, মেয়ে মানুষ করতে হলে শহরে থাক প্রয়োজন। কেন বাবা তোরা কি মানুষ হইস নাই? গ্রামের খাল, বিল, পুকুরে গোসল করছিস। গ্রামের শাক পাতা, ফুল, ফলাদি খাইছিস। গ্রামের মাঠ ঘাটে ঘুরে বেড়াইছিস খেলছিস। এরকম খোলামেলা পরিবেশ শহরে পাবি কোথায়? গ্রামের ধুলাবালি গায়ে মাইখাই বড় হইছিস। আমি চাই আমার নাতি, নাতনিরাও সেইভাবে মানুষ হোক। ফোনটা রাখার পর কল্পনা মনোক্ষুন্ন হয়ে বসে থাকে। টুটুলের খারাপ লাগে। ছেলে নাতি, নাতনিদের দেখার জন্য কল্পনার মনটা অস্থির হয়ে থাকে।
ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না। কল্পনা বেগমের সময় কাটে রোজা, নামাজ, বই পড়ে, ভালো না লাগলে পুকুর পাড়ে যায়, নিজের একটি ছোট্ট পরিসরে বাগান আছে তা পরিচর্যা করে সময় চলে যায়। অনেক লোকজন তার কাছে আসে নানা বিষয়ে পরামর্শ নিতে। সেও তাদের কথা শুনে ভালো পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করে। মানুষ উপকার পায়। সবার কাছে‌ সে আস্থাভাজন ব্যক্তি। শুধু নিজের ছেলেদের কাছে সে সেকেলে মা, সে কি বুঝে! যত কিছুর বুঝ বোঝে তারা।
ছেলেদের নিয়ে চিন্তাভাবনায় কল্পনা বেগমের মন সব সময় অস্থির। এই অবস্থা দেখে টুটুল মিথ্যা বলে ফোন করে দুই ছেলের কাছে। টুটুল জানায় তাদের মা ভীষণ অসুস্থ বিছানায় পড়ে আছে। মা তাদের দেখতে চেয়েছে। এমন কথা শুনে দুই ছেলে তার পরিবার নিয়ে মায়ের কাছে ছুটে আসে। এসে দেখে তার মা সুস্থ শরীর নিয়ে বসে আছে। কল্পনা তো ছেলে, বউ, নাতি, নাতনি দেখে বেজায় খুশি। সে মনে করে মাকে খুশি করার জন্য চমকে দিতে না জানিয়ে এসেছে সবাকে নিয়ে। দুই ছেলে একসঙ্গে বলে উঠে, মা তার মানে তুমি আমাদের মিথ্যা কথা বলে আনছো? কি মিথ্যা কথা বলছি বাবা! তুমি অসুস্থ, বিছানায় পড়া, আমাদের দেখতে চাইছ।
টুটুল এসে মাথা নিচু করে বলে, ভাইয়া খালাম্মা এসবের কিছুই জানে না। যা করছি আমি করছি। কি করুমু খালাম্মা আপনাদের জন্য মন খারাপ করে, কান্নাকাটি করে। তাই আমি এই কাজ করেছি। ফারহানার আর মিলি দুই বউ চেঁচিয়ে ওঠে, এটা কোন কাণ্ড হলো? ওখানে কি অবস্থায় ফেলে রেখে ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাদের ছুটে আসতে হলো। কথা থামিয়ে কল্পনা বেগম বলেন, থাক মা, টুটুলের এমন কান্ড করা উচিত হয়নি। তোমরা আসো খাওয়া-দাওয়া সেরে নাও। বউদের ক্ষোভ কমেনা, রাখেন আম্মা।
আমরা এখানে কিভাবে এসেছি সে আমরাই জানি। আপনি বুঝতে পারবেন না। ছেলে মেয়েরা কতটা পড়ায় পিছে পড়বে জানেন? এই আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয় নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। খাওয়া-দাওয়ার পর প্রস্তুত হয়ে ছেলেরা বলে, মা এখন আমরা চলি। কি বলিস বাবা? আসছিস, অন্ততপক্ষে দুইটা দিন থাক। সে কথায় অমত করলে বলেন, না হয় আজকের রাতটা থেকে যা। না মা তা কিছুতেই সম্ভব না। নাতিরা সবাই মিলে তাদের বাবাকে বলে, আমরা দাদির কাছে থাকবো। তোমরা চুপ থাকো। নাতিদের ধমক দেওয়া দেখে আহত হলেও কল্পনার কিছুই বললেন না। লাঠি ভর করে কল্পনা বেগম কিছুদূর ছেলেদের এগিয়ে দিয়ে আসে। অনেকক্ষণ উদাস নয়নে ছেলেদের যাত্রা পথে দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেরা যাওয়ার পরে কল্পনা সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়ে পড়ে।
এত অসুস্থ হলো যে ডাক্তারের ওষুধপত্রে কোন কাজ হয় না। বিছনায় কাতরাতে কাতরাতে ছেলেদের কথাই বারবার বলতে থাকে। অবস্থা খারাপের দিকে যায়। টুটুল দুই ছেলেকে তাদের মায়ের অসুস্থতার কথা জানায়। ছেলেরা ভাবে টুটুল এবারও মিথ্যা কথা বলছে। তারা সে কথার গুরুত্ব না দিয়ে বলে, অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখাও। আমরা এসে কি করব আমরা কি ডাক্তার? অসুস্থতার কথা মিথ্যা মনে করে তারা মাকে দেখতে আসে না। মায়ের সঙ্গে কথা বলে সত্য মিথ্যা জানানোরও চেষ্টা করে না। এমন অবস্থায় এক সময় কল্পনা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। পরিজনহীন এমন করুণ মৃত্যু টুটুলকে সীমাহীন ব্যথিত করে। অভিমানে সে মনে করে, মৃত্যু সংবাদ জানালেও হয়তো ভাববে মিথ্যা বলছি। বেঁচে থাকতে যারা মায়ের মুখ দেখল না মরে যাওয়ার পর দেখে কি হবে।
মায়ের ব্যাকুলতা
লেখক- সম্পাদক ও কথাশিল্পী
মায়ের ব্যাকুলতা

Additional information

লেখক

প্রকাশ

One response to “মায়ের ব্যাকুলতা”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

মায়ের ব্যাকুলতা

Download(125 KB)

Recently Viewed Products

No recently viewed products to display
Review Your Cart
0
Add Coupon Code
Subtotal